হঠাৎ সেদিন আমার বর বললো একটা ফেস্টিভেল নাকি হবে,লন্ঠন উৎসব (Lanternchen Festival) ! আমি একটু উৎসুক হয়ে উঠলাম। সব সময় বইয়ে পড়েছি, টিভি তে দেখেছি, কিন্তু সরাসরি এই প্রথম কোন স্থানীয় লোকজ উৎসব দেখবো! অপরাপর সমাজ,ইতিহাস, তাদের সংস্কৃতি সব কিছুই আমাকে বরাবরই আকর্ষণ করে। ফেস্টিভাল আর কার্নিভাল সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে উৎপাদিত একটি ধারণাগত কাঠামো, যা কিনা যুগে যুগে নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধরে রাখার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করে আসছে।
বাড হোমবুর্গে সর্বপ্রথম ১৯৩৫ সালে Homburg in the light মোটো নিয়ে অালোয় আলোকিত করার, রঙে রঙিন করার উদ্দেশ্য নিয়ে লন্ঠন উৎসব (Lanternchen Festival) অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৩৪ সাল থেকেই মূলত এই উৎসবটির পরিকল্পনা করা শুরু করেছিলেন শহরের তৎকালীন মেয়র। ক্যাসেলের সাদা টাওয়ারের ওপর থেকে আঠারোবার তোপধ্বনি ও লন্ঠনের আলোর সংকেত দেখানোর মধ্য দিয়ে সেসময়ের লন্ঠন উৎসবের সূচনা হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালীন বর্বরতায় এই উৎসবটি বন্ধ হয়ে যায়।
বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ভেঙ্গে যাওয়া জার্মানীতে উৎসবের পরিবেশ তো ছিলই না! চারিদিকে অাতঙ্কগ্রস্ত মানুষ,নিজেদের দৈনন্দিন জীবনকে সুরক্ষা দেবার চেষ্টায় মশগুল! ১৯৪৯ সালে প্রায় দশ বছর পরে আবারও এই লোকজ উৎসবটির আয়োজন করার প্রস্থাবনা করা হয়েছিল।পরবর্তী কয়েক বছর ধরে অনেক নতুন ধারণা এসেছিল, যা লণ্ঠন উৎসবকে আরো সুন্দর, এমনকি আরো বেশি রঙিন করতে সহায়তা করেছিল।। কিছু এক বছর বা কয়েক বছর ধরে ছিল, অাবার কিছু অাজও রয়ে গিয়েছে উৎসবটির মাঝে! এমনকি এই সময়টা
তে নিজেদের বাসার জানালাতে,বারান্দায় ,বাগানে ছোট ছোট লন্ঠনসহ নানাধরনের আলো দিয়ে সাজিয়ে তোলে! রাতের রাস্তাতেও যেন সেই লোকজ অাবেশ!
১লা সেপ্টেম্বর, আমাদের এখানে সেদিন ঈদ, সাথে এই ঐতিহ্যবাহী উৎসব। সারা শহরের মানুষের ঢল নেমেছে। এমনকি বাইরে থেকেও অনেকে এই উৎসবে সামিল হতে এসেছে! মজার বিষয় হলো উৎসবটি ঠিক আমার বাসার পাশেই। ঈদের দিনই আমরা ছেলেকে নিয়ে গেলাম ঢু’ মারতে। কিন্তু, ঢুকেই যেন বিপদ হলো, ছেলে যে রাইডই দেখছে সেটাতেই চড়তে চাইছে। এমন হলো যে, একটা রাইডেই উনি সাত-আটবার চড়েছেন, নামতে চাইছেই না! ইচ্ছা করলেও আমরা কেউই পুত্রকে দেশীয় কায়দায় ‘শাসন’ (মাইর) করতে পারছি না, ধৈর্য্য এর পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছি দু’জনেই সমান তালে। কিছু দূর পর পরই বিশাল স্টেজ করে কনসার্ট হচ্ছে। গান শুনবো কি, ছেলে গানের তালে তালে দৌঁড়াচ্ছে আর আমরা দুই অভাগাও তার পিছু পিছু দে দৌঁড়!! হাজার হাজার মানুষের ভীড়ে যেন পুত্র অামার প্রায়ই হারিয়ে যাচ্ছে!
একদম বৃদ্ধ থেকে শুরু করে একদম শিশু, সবার যেন আর বাসাতেই মন টিকছে না,তাই সবাই ভীড় করেছে তাদের এই ঐতিহ্যের সাথে!! এটি এই অঞ্চলের অন্যতম সুন্দর উৎসব। এখানে প্রায় প্রতিবছর ৪০০০০০ দর্শকের সমাগম ঘটে! প্রায় ২০০ টিরও বেশি স্টল,খাবার দোকান সহ নানাধরনের রাইডের চাকচিক্যে ভরপুর হয়ে ওঠে এলাকাটি!
সবচেয়ে মজা পেয়েছিলাম যখন হঠাৎ দেখলাম যে রোড শো হচ্ছে,সবাই দেখার জন্য ছুটে যাচ্ছে নিজেদের ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে আর আমার বাসার সামনে হওয়ায় আমরা বারান্দা থেকেই উপভোগ করতে পারছি! কিন্তু, ভীড়ে সামিল হওয়ার অানন্দের সাথে যেন কোন কিছুরই তুলনা মেলে না, অগত্যা
এক সময় অবিষ্কার করলাম আমরাও সেই রাস্তার সকলের সাথে মিলে গিয়েছি! একেকটা থিমের ওপর ভিত্তি করে একেকটা ভ্যান সাজানো হয়েছে, সাথ আলোকসজ্জা আর মন মাতানো লোকজ বাজনা যেন মুহুর্তেই সবাইকে মাতিয়ে দিয়ে গেল! প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে চললো, আশেপাশের সকলেই যেন শিশু হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য!!
উৎসবটি শেষ হলো চারদিন পর জুবলি পার্কের অন্ধকারে হঠাৎ জ্বলে ওঠা হাজার অাতশবাজির আলোর মধ্য দিয়ে। বাসা থেকে পেছনেই সেই পার্কটি, আমরা তিনজন যাচ্ছি, সাথে শতশত মানুষ,রাতের অন্ধকারে আমাদের সামনে পেছনে পাশে, সবাই ছুটে যাচ্ছে। কোথাও দাঁড়ানোর জায়গা নেই। ছেলেকে কোলে নিয়ে আমরাও মিশে গেলাম অাতশবাজির উৎসবে। এত মানুষ তাও যেন এতটুকু বিশৃঙ্খলা নেই,কেউ কারও গায়ের ওপর গিয়ে পড়ছে না,কোলাহল করছে না!! মনে হচ্ছিল যেন এভাবেই মানুষ নিজেদেরকে, পরিবারকে,সমাজকে আলোকিত করে তুলবে নিজেদের বোধকে জাগিয়ে তোলার মধ্য দিয়ে!!
Leave a Reply