আমি তখন জাহাঙ্গীরনগর নামক জঙ্গলেঘেরা সুন্দরবন টাইপের অসাধারণ সুন্দর এক জায়গার স্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়ি।
হঠাৎ একদিন দেখলাম ম্যাজেন্ডা রঙের ফ্রক আর পায়ে কেডস পরে বয় কাট কারলি চুলের একজন প্রায় দেখতে বিদেশিনীর মতো আমাদের ক্লাসে নতুন আসলো। সে আবার কথায় কথায় ইংরেজি বলে!!
তার সামনে তো খুব ভাবেই থাকি,আর পিছনে তো হাসতে হাসতে অস্থির অবস্থা!!!
কিছুদিনের মাঝেই খবর আসলো সে নাকি তার বাবাকে ‘ড্যাডি‘ ডাকে…কি ভাব রে বাবা!!!…..
এই বিদেশিনী মেয়েটি ছিল আমাদের ইফ্ফাত….এই ইফ্ফাত নামটা লিখতে গিয়ে কেমন যেন আজকে অপরিচিত লাগছে!! কারণ ও যে কবে ইফ্ফাত থেকে ইফু হয়ে গিয়েছিল…মনে পড়েনা!!! মনে পড়ে ইফুদের সেই দুই নম্বরের বাসায় টারমিনেটর-২ দেখে আমার সে কি কান্না!! কিছুক্ষণ পর দেখা গেলো ঐশীও ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছে!!! অার তারপর চাচীর হাতের মজাদার রান্না…আহ্….কী দিনই না ছিল!!!
ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন। একদিন একটা ডিনার পার্টিতে গিয়েছি। দেখি একজন শুকনা ছোট্ট মেয়ে আর তার সাথে নাদুসনুদুস আরেকজন। এই নাদুসনুদুস জন দেখি আমার সাথে কি ভাবটাই না মারছে!!! আমি মনে মনে ভাবি…চান্দু এখনও তো চিনতে পারো নাই কার সাথে ভাব ধরছো!! সেই দিন ক্যাম্পাসে আসলা…আর অামার ক্যাম্পাসে এসে আমারই সাথে ভাব ধরতেছো!!! কয়েকদিন পরে দেখি..আরে এই মেয়ে দেখি আমাদের স্কুলে পড়তে এসেছে!!! আমি, ইফু আর ঐশী….আমাদের সে কি হাসি একে দেখে…হা হা হা….!!! কিছুদিনের মাঝেই আবিষ্কার করলাম…এ মেয়ে তো বিরাট বাচাল!!!
একবার কথা শুরু করলে আশেপাশের কেউই আর মোটেও চান্স পায়না!! আর এই মেয়ে তার জুতার কালেকশন আর কবে তার বিয়ে হবে এ্ই বিষয় ছাড়া কথা শুরু বা শেষ কিছুই করতে পারেনা।
আমার বাসার কাছে, তাই দেখা গেলো স্কুল শেষে ফেরার পথে সে আমার সাথেই যাচ্ছে আর আমি তার জুতার কালেকশনের গল্প শুনছি!!! বড়ই আজিব!!! এইভাবে যাওয়ার সময় একদিন আমাদেরকে কুত্তা তাড়া করলো……কুত্তা একবার ওর কাছে তেড়ে যায় আর একবার আমার কাছে আসে!!! হি হি হি……
আর ঐশী… সে তো বরাবরেরই পাগলা..!!
রাগ উঠলে প্রায় প্রদিদিনই সে স্কুলের সামনের মাঠের মাটি তুলে কসম খায় যে আর নাকি সে আমাদের সাথে কথা বলবে না….কিন্তু জীবন বড়ই কিম্ভুত!!…
কারণ পরেরদিনই দেখা যেতো সে আমাদের সাথে কথা বলা শুরু করেছে…!!!
ক্লাস এইটে….পুরাই ড্যাম কেয়ার আমরা!! প্রতি ক্লাসের পর গ্রুপ বেঁধে ক্লাস থেকে বের হয়ে পুরা স্কুলে রাউন্ড না দিলে যেন মাস্তানিটা পাকাপোক্তই হয়না!! কিন্তু টিফিনের আগে তো বের হেওয়া মানা!!…শুধু বের হতাম তাই না
সাথে আবার সবাই মিলে গান গাইতে গাইতে টহল দিতাম…..সেই রকমই টহলের একদিন গান গাইতে গাইতে দেখলাম ফজলুর রহমান স্যার ক্লাস নাইনের পড়াচ্ছেন। আমি সাথে সাথেই গান বন্ধ করে দিলাম….অন্যরা তো বিন্দাস টাইটানিকের গান গেয়ে স্যারের ক্লাসের সামনে দিয়ে গেলো..অবশ্যই আমিসহ!!! কিছুক্ষনের মাঝেই স্যার ক্লাসে এসে উপস্থিত!! হাসোজ্জ্বল মুখে জানতে চাইলেন…কিছুক্ষণ আগে যারা গান গাচ্ছিল তারা কারা…..ফজলুর রহমান স্যার বলে কথা….সবাইকে তো স্বীকার করতেই হবে সত্যিটা….তাই সবাই দাঁড়ালো…ওমা দেখি কী শুধু ঐশী বেকুবই দাঁড়িয়েছে…বাকিরা সবাই বসে আসে ভয়ে….আর মাঝখানে আমি তো মোটামোটি মাথা উচু করেই বসে আচি,কারণ আমি তো ঐ সময় গান গাইনি..আর ঐশী হতভম্ভ হয়ে আমাদের দিকে তাকাচ্চে আর আমাদের বিশ্বাসঘাকতায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে….হি হি হি!!! স্যার বললেন…ঐশী কী গান যেন গাচ্চিলে…আবার সবার সামনে গাও তো!!! এবার ঐশী কাঁদতে কাঁদতে ক্লাসের সবার সামনে গেখি গানও শুরু করলো….‘এভরি নাইট ইন মাই ড্রিম…আই সি ইউ…আই ফিল ইউ’….. এই ঘটনার পর ঐশী আবার মাটি হাতে নিয়ে কসম কাটলো যে সে আর আমাদের সাথে কোন সম্পর্ক রাখবে না….!!!!
অথবা তোদের কি মনে পড়ে সেই ক্লাস পালানোর দিনগুলি…যখন একজনের পেছন একজন করে পালাতাম!! বা ম্যাবসের সেই ভোরগুলি যখন ভোর ছয়টায় আমরা বাসে উঠতাম….আর আমরা না ওঠা পর্যন্ত বাস ছাড়া হতো না!!!!!
ভিসির মেয়ের আর তার প্রাণের বান্ধবীদের ঢাকায় যাওয়া নিয়ে কথা…না আসলে ছাড়বে কেন!!!! বাসের সবা্র সে কি বিরক্তি!! আর সেই বাসেই হাজারও মানুষের ভীড়ে মোটু..তোর মনে আছে…তুই আমাদের খাইয়ে দিতি…?? কারণ আমরা কেেই ঘুম থেকে উঠে না খেয়েই দৌঁড় দিতাম!!! জ্ঞানপিপাসু এই আমরা…..সকালে ম্যাবস এ গিয়ে ক্লাসে ঘুমিয়ে পড়তাম আর স্যারেরা বকা দিলে মাসুমের মতো মুখ করে বলতাম…
‘স্যার আমরা তো অনেক দূর থেকে আসি…সকালে ভালো করে ঘুমাতে পারি না!!!’’’…….
আর সবাই মিলে নিচের দোকান থেকে কি খাওয়াটাই না খেতাম রে…..মনে আছে ম্যাবসের গার্ড বেয়াদবি করেছিল বলে…আমরা তার বসার জায়গায় সস লাগিয়ে সে কি দৌড়…..আর ফেরার পথে বাসের পেছনের দরজায় দাঁড়িয়ে এক পা বের করে আসতেই হবে.. যতবার কউ নামবে আমরাও নামবো ….
বাস ছেড়ে দিলে দৌড়ে বাসে ওঠার আগে মোটুকে আমি পেছন থেকে আর ইফু সামনে থেকে টান দিয়ে বাসে ওঠানোর আপ্রাণ চেষ্টা করো….আর মোটুর সে কি চিৎকার…‘ঐ বাস থামা…বাস থামা…’….
এভাবেই দিনগুলি কেটেছে……সবাইকে বিরক্ত করে আর নিজেরা প্রাণ ভরে আনন্দ করে….েইফুর আর আমার সারা রাত ধরে লাইফ প্ল্যান করতে করতেই দিন চলে যেতো….বা ঈশি জানালোর ধারে পড়তে বসলে আমরা দল বেধে ঐ সময় বাংলা সিনেমার গান না গাইলে যেন বাত হজম হতো না….উদ্দেশ্য ঈশি কে পড়তে না দেয়া…..
আমরা দি এ টিম…. জঙ্গলে সিনেমার শুটিং বা সারা ক্যাম্পাসে গলা ফাটায় গান গেয়ে রিকসায় দলবেধে ঘুরে বেড়ানো……খুব মিস করছি…..মিস করছি তোদের সবাইকে……ভালবাসি তোদের সবাইকে….তোদের সবার অনেক বন্ধু হয়েছে…..কিন্তু তোরা ছাড়া আমার আর কোনই বন্ধু নেই…..
রইলো না ……রইলো না…..সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি…………..
Leave a Reply