ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক অপূর্ব মেলবন্ধন স্বপ্নের শহর বার্সেলোনা। ভূমধ্যসাগরের রানী বলা হয় বার্সেলোনাকে। নৈপুণ্য, কর্মব্যস্ততা, আভিজাত্য, প্রাচীন ইতিহাস এবং আধুনিকতার সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে এই শহর। অভিযাত্রী কলম্বাস অজানাকে আবিষ্কারের নেশায় সাগরের বুকে পাড়ি দিয়েছিলেন প্রায় ৫০০ বছর আগে কাদিজ বন্দরের অদূর থেকে, কিন্তু ‘নতুন পৃথিবী’ জয় করে সান্তা মারিয়া বন্দরে ফিরে এই বার্সেলোনায় প্রথম অবতরণ করেছিলেন তিনি।
দুপুরের খাবারটা হোটেলেই শেষ করলাম। তখন প্রায় চারটা বেজে গিয়েছিল। সবাই মিলে ঠিক করলাম, খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যায় বের হবো। যদি তখনও বৃষ্টি হয়? হোক না!! সন্ধ্যা রওনা হলাম লা রাম্বলার উদ্দেশ্যে। আমাদের হোটেল থেকে বেশি দূরে নয়। লা রাম্বলা মূলত রাস্তার পাশ ঘেঁষা গাছের সারি পূর্ণ অতন্ত ব্যস্ততম একটি রাস্তা। রাস্তায় দুধারে বিভিন্ন দোকানও রয়েছে। টুরিস্টরা সেখানে দরদাম করে বিভিন্ন জিনিস কিনছেন। এই রাস্তাটিকে সবসময়ই দেখতে ভীষণ সবুজ লাগে।সবুজে ঘেরা এই রাস্তাটি অনেক সতেজ ও সুন্দর। এখানকার সকলের মতে এই সজীবতা তাদের ভেতরেও অনেক স্বস্তি দেয়, তাদেরকে প্রাণবন্ত রাখে। প্রাণবন্ত এই সবুজের মেলা চোখেও বেশ শান্তির দৃশ্য দেখায়। পর্যটকদের শ্রোতে লা রাম্বলা’র প্রশস্থ পথটি যেন একটি দীর্ঘ মিছিলের রূপ নিয়েছিল। অামাদেরও খুব ভাল লাগছিল। বের হবার আগেই অামরা সাবধান হলাম নিজেদের ব্যাগ নিয়ে। কেন? কারণ পিট পকেটিং এখানে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। মৃদু হাওয়ায় হাঁটতে খুব ভাল লাগছিল। ইবাদা আর লিওনেল দৌঁড়াচ্ছিল। রাস্তা কেউ গান করছে, কেউ বা গল্প করছে, কেউ কেউ আবার সব বন্ধুরা মিলে গান গেয়ে গেয়ে নাচছে!! দেখলাম একজন বৃদ্ধাও তাদের দেখে দেখে নাচছে!! আহা!! আমারও যে ইচ্ছে করছিল না তা বলবো না। বেশ রাত হয়ে যাচ্ছে দেখে রাতের খাবারের উদ্দেশ্যে ফিরে চললাম। রোমেল ভাইয়া বলছিলেন, সাবধান কিছু মানুষকে আমার কিন্তু সুবিধের লাগছে না। বলতে বলতেই একজন মহিলার চিৎকার, আর সবার চোখের সামনে দিয়েই এক ছেলে একজন টুরিস্টের হ্যান্ড ব্যাগ টান দিয়ে অলিম্পিক স্টাইলে দৌঁড়!! আমরা হতভম্ব!! এই ঘটনার পরে যাকে দেখি, তাকে দেখেই মনে হয়, নিশ্চয়ই ব্যাটা চোর!! পরে জানলাম ট্রেম স্টেশনেও ১২ টার পরে সব বন্ধ করে দেয়া হয় নিরাপত্তার জন্য। জানতে পারতাম না, একদিন রাত পৌনে বারোটা বেজে গিয়েছিল ফেরতে। সেদিন দেখলাম সব দরজা বন্ধ করার জন্য নিরাপত্তা রক্ষীরা দাঁড়িয়ে আছে!! তাদের কাছেই জানতে পেরেছিলাম। এরপরে আসলে কি হতো আল্লাহই জানেন!!
লা রামব্লাতে বিশাল বড় মার্কেট রয়েছে যেখানে নানা ধরনের খাবার পাওয়া যায়। এত মানুষের ভীড় থাকে সবসময় যে বলাই বাহুল্য!! কাচা মাংস, মাছ, ফল, চকলেক, রান্না করা খাবার, কি নেই যে সেখানে সেটাই বলা মুশকিল!!
পরেরদিন সকালে রওনা হলাম ক্যাম্প নু এর উদ্দেশ্যে। অামরা সবাই উত্তেজিত। ঢোকার মুখেই টিকেট কাউন্টার। তারপর বেশ বড় পথ পার করে স্টেডিয়ামের দোকান। সেখানে জার্সি, বলসহ নানা খেলার মামগ্রী পাওয়া যায়। দোকানের ডিজাইনটিও বেশ সুন্দর। সেখান থেকে বের হয়ে ন্যু ক্যাম্প মিউজিয়াম। সারি সারি দিয়ে রাখা রয়েছে কাপগুলো,ছবি, জার্সিসহ অারও অনেক কিছু। যে একবার যেখানে দেখার
জন্য দাঁড়াচ্ছে, সে আর সরতেই চায় না, ভক্ত বলে কথা!! মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েই থাকে!! সেখান থেকে বের হয়ে দেখলাম তাদের ম্যাসাজের জায়গা, প্রেস ব্রিফ্রিং হলরুম। শেষই হতে চায় না যেন। কাপসহ ছবি তোলারও ব্যবস্থা রয়েছে। ছবি তোলার পরে আপনার পছন্দ হলে আপনাকে কিনে নিতে হবে ছবিগুলো।
এরপর সেই সিড়িগুলোতে পৌঁছলাম যেগুলো খেলোয়ারদের ড্রেসিং রুম থেকে বের হয়ে খেলার মাঠে প্রবেশ করে। স্টেডিয়ামটি এত বড় যে অামাদের ঘুরে শেস করতে করতে প্রায় ৩টা বেজে গিয়েছিল। ইবাদা আর লিওনেল তো বটেই, আমরা বড়রাও ক্ষুধায় কাতর হয়ে গিয়েছি। এদিকে এখনও নাকি শেষ হয়নি!! লিফট বন্ধ, তারপরেও দুই দুইটা বাচ্চা দেখে তাদের মনে কিছুটা মায়ার সঞ্চার হলো। তাই অামাদের লিফটে করে নিচে নিয়ে গেল। সৌভাগ্যই বলতে হবে। নইলে বের হতে হতে অারও ১ ঘন্টা লেগে যেতো!!
খেয়ে দেয়ে রওনা দিলাম সমুদ্র সৈকতের দিকে। বার্সেলোনা সমুদ্র তীরবর্তী হওয়ায় শহরে থেকেও এক পা বাড়ালেই চোখে পড়ে দিগন্ত বিস্তৃত বিশাল জলরাশি। অনেক পর্যটকেই আসেন নিজেদের নাগরিক জীবন থেকে ছুটি নিয়ে পরিবার বা প্রিয়জনের সাথে বার্সেলোনার সমুদ্র সৈকতে নির্জন মুহুর্ত কাটাতে, আর প্রিয়জনের সঙ্গে উপভোগ করতে চান ঐতিহাসিক শহরের আনাচ-কানাচ। পুরো বার্সেলোনা শহরকে কেন্দ্র করে আছে সাতটি সমুদ্র সৈকত। এসব সৈকতে সূর্যস্নান উপভোগের জন্য পর্যটকদের মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
সাগর পারের বেলাভূমিতে পৃথিবীর নানা দেশ থেকে আসা শত শত নারী পুরুষ এবং শিশু কিশোরদের নানাবিধ কর্মকান্ডে যেন সৈকতটি এক পর্যটক মেলায় পরিণত হয়েছে।কেও স্বল্প বসনে প্রখর রোদ্রের মধ্যে শুয়ে আছে,কেউ সাগর জলে শরীর ভেজাচ্ছে, কেউবা ছুটোছুটিতে মগ্ন। দূরে বিশাল জলরাশির মধ্যদিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে নানা আকৃতির ছোট বড় পর্যটন জাহাজ। তীর ঘেসেই রয়েছে অনেক খাবার দোকান। কোনটিই ফাঁকা নয়। তাও একটিতে ঢুকে পরলাম। সেখানের প্রায় সবাই বাংলাদেশ থেকে এসেছে। তারাও দেশি মানুষের দেখা পেয়ে খুশিই হলো। নানা রকমের সিফুড। কোনটি ডিপফ্রাই, কোনটি বয়েলড, আবার কোনটি রান্না করা। তবে স্বাদ অসাধারন। আমি একজন ভোজনরসিক। ইন্ডিয়ান ফুডের পর এই একটি দেশ পেলাম যার খাবার আমার বেশ পছন্দ হয়েছে।
পার্ক গুয়েলের মেইন জায়গাটির ভেতরে যাওয়ার জন্য আমরা টিকেট পাইনি। তবে পুরো পার্কটি ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছে। পার্ক থেকে পুরো বার্সেলোনা শহর , এমনকি শহর পেরিয়ে নীল সমুদ্র আর নীল আকাশের এক হয়ে মিশে যাওয়াও দৃশ্যটিও এখান থেকে দেখা যায়। অপূর্ব এক দৃশ্য। তবে গরমের ভেতর অামাদের ওপরে ওঠা এবং নিচে নামা বেশ পরিশ্রমের ছিল। মনে হচ্ছিল রোদের মাঝে মাথা ঘুরিয়ে পরে না যাই!! ওপরে উঠে মনে হয়েছিল , যাক এত কষ্ট তাহলে স্বার্থক হলো!!
এবার গেলাম, লা সাগরাডা ফামিলিয়া। আন্টনিও গাওডির সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ। যার জন্যে তিনি পৃথিবী জুড়ে সমাদৃত। তাজমহল করতে ২২ হাজার শ্রমিকের ২০ বছর লেগেছিল, তাতেই মোঘল রাজকোষ আর জনগণের নাকি ত্রাহি অবস্থা হয়েছিল! আর সেইখানে যদি ২০০ বছর লাগে কোন স্থাপত্য গড়তে তাহলে কী অবস্থা হবে? চোখ কপালে তুলে নিশ্চয়ই ভাবছেন ২০০ বছরে রাজা তো রাজা, রাজত্ব পর্যন্ত বিলীন হয়ে যায় কালের গর্ভে, আর কোথাকার কোন স্থাপত্য! কিন্তু আসলেই এমন একাধিক অবিশ্বাস্য কীর্তি আছে মানুষের, যা গড়তে লেগেছে কয়েকশ বছর, প্রজন্মের পর প্রজন্ম! আর তাদের মধ্যে একটির নির্মাণ কাজ চলছে এখনো , যার শুরু হয়েছিল ১৮৮২ সালে, ধারণা করা হচ্ছে আধুনিক সমস্ত প্রযুক্তি নিয়েও শেষ করতে চলে যাবে আরও কয়েক দশক, এদিকে মূল স্থপতি অ্যান্তোনি গাউডি না ফেরার দেশে চলে গেছেন ১৯২৬ সালেই, কিন্তু বিপুল কর্মযজ্ঞ থেমে নেই, চলছে তার দিয়ে যাওয়া নকশা মোতাবেকই।সত্তর বছর বয়সে ট্রাম চাপা পড়ে তিনি মারা গেলে, দুদিন পর তাকে এর মধ্যেই সমাহিত করা হয়।
খেলাপাগলদের বার্সেলোনার ন্যু ক্যাম্প আর অলিম্পিক ভিলেজ, রৌদ্র প্রত্যাশীদের জন্য উষ্ণ বেলাভূমি, ভোজনরসিকদের জন্য হাজার রেস্তোরাঁ, শিল্পবোদ্ধাদের জন্য পিকাসো জাদুঘরসহ নানা শিল্প সংগ্রহ থাকলেও বার্সেলোনায় প্রায় প্রতিদিনি সবচেয়ে বেশি মানুষের জমায়েত ঘটে ল্য সাগ্রাদা ফ্যামিলিয়ার মূল ফটকে, যেখানে দাঁড়ালেই হয়ত সেই মূল্যবান দিনটির দুই-দুইটি ঘণ্টা টিকেটের অপেক্ষায় ব্যয় হবে অতি মন্থর ভাবে, আর যদি লিফট বেয়ে উপরের অংশে দাঁড়িয়ে গির্জা এবং তিলোত্তমা নগরীটির দিকে সপ্রশংস দৃষ্টি বোলাতে চান সেখানেও খরচ হবে বিস্তর সময় ও সামান্য অর্থ। কিন্তু হায়, টিকেট পেলাম না। দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। তাই বিকেলের টিকেট কিনতে হলো। দেখলাম আধুনিক প্রযুক্তির দান আকাশ ছোঁয়া বেশ কটি ক্রেন এবং অন্যান্য নানা সরঞ্জাম, এদের সাহায্য নিয়েও নির্মাণযজ্ঞ চলছেই দশকের পর দশক, মাঝে বলা হচ্ছিল গাউডির মৃত্যু শতবার্ষিকীতে ২০২৬ সালে শেষ করা হবে নির্মাণ কাজ, এবং তাতে প্রতিফলিত হবে গাউডির স্বপ্ন। কিন্তু ইতিমধ্যেই বলা হয়েছে অন্তত আরও ২ বছর লাগবে সম্পূর্ণ কাজ শেষ হতে, এবং তারপরেও বলা সম্ভব হচ্ছে না গাউডির আদি নকশা অনুযায়ী, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়েও ২০০ বছরে কাজটি শেষ হবে তো! যে কারণে স্থানীয় অনেক মানুষই এই মন্দার বাজারে এমন ব্যয়বহুল নির্মাণ কাজের বিরুদ্ধে, যদিও সেই কারণেই ফি বছর আসছে মিলিয়ন পর্যটক।
আবার নির্মাণ শেষ হলে এটি বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু চার্চ। মূল ফটক আসলে তিনটি, যার প্রতিটিতে খোদাই করা আছে বাইবেলের নানা বিষয়ভিত্তিক কাহিনী! দৃষ্টিনন্দন সব শিল্প কর্ম তৈরি করা হয়েছে জানালার বর্ণীল কাঁচ দিয়ে, তার গ্রহণযোগ্যতা আবার শত গুণে বাড়িয়ে দেয় সগৌরবে প্রবেশ করা অবারিত সূর্যকিরণ, ভিতরে গড়ে উঠে একের পর এক জাদুমুহূর্ত। মানুষের সৃষ্টির প্রতি মুগ্ধতায়, মানুষের কল্পনাশক্তির অপরিমেয় ক্ষমতায় শ্রদ্ধা ফিরিয়ে নিয়ে আসে এমন অমর কীর্তি, হোক না তা নির্মাণাধীন, হোক না তা কোন কল্পিত দেবতার উদ্দেশ্যে নির্মিত।
এছাড়াও অামরা বার্সেলোনা অ্যাকুরিয়ামে গিয়েছিলাম। এত সুন্দর বানিয়েছে যে কি বলবো!! অঅমাদের দুই ক্ষুদে সদস্য তো বেজায় মজা পেয়েছে। এবং অতি আনন্দে এক সময় ঘুমিয়েও পরেছে ক্লান্ত হয়ে!!! পোর্টের ধার ঘেষে অনেক দোকান। দোকানের প্রায় বেশিরভাগই বাংলাদেশি এবং আফ্রিকান। বাংলাদেশিরা অনেকেই অনেক বছর হয় যে দেশে যেতে পারছেন না বৈধ কাগজ না থাকায়। তাদের কাছ থেকেই কিনবো বলে অামরা ঠিক করেছিলাম। অনেক কিছুই কিনলাম।
রাত নামলো। রাস্তায় আলো জ্বলে উঠতে শুরু করলো। পরেরদিন ফিরতে হবে আমাদের। হয়তো অন্য আরেকটি জায়গায় যাবো। কিন্তু কবে যাবো? সেই দিনটির অপেক্ষা করতে করতেই বার্সেলোনা ছাড়লাম আমরা!!
Leave a Reply