নীরার এখন আচমকাই বেকার জীবন চলছে। তার মানে হলো মানুষ যাকে বলে অর্থ উপার্জন না করে দিন পার করা! নীরা ভাবে, সমাজের মানুষ এখনও ঘরের কাজকে সেরকম স্বীকৃত কিছু ভাবতে অভ্যস্ত নয়। তাই সে সারাদিন সংসার ও সন্তানের পেছনে তার সবটুকু সময় ব্যয় করেও বেকার; ‘প্রোডাক্টিভ‘ কিছু করতে না পারার নিয়মে। এগুলো তো আদিকালের পুরানো হয়ে যাওয়া প্যাচাল।
হঠাৎ এই জীবন কেমন লাগছে নীরার? এটা নিয়ে আজকাল প্রায়ই ভাবে সে!! ব্যালকনিতে কফির মগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে সে। রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখছে মানুষের কর্মব্যস্ততা। আচ্ছা যেকোন কাজেই কি সে আনন্দ পায়? এই সংসার তার খুব ভালবাসার আর যত্মের। তারপরেও শুধু সংসার সামলানোতে বুঝি জীবনের সবটুকু আনন্দ নেই!! ভাবতেই হেসে ফেললো সে।
সেই কাজ করেই সে আনন্দ পায়, যে কাজে স্বীকৃতি আছে, মূল্যায়ন আছে। পৃথিবীতে উৎপাদন আর পুনরুৎপাদন খুবই গুরুত্বপূর্ণ , সেই অর্থে চিরাচরিত ভাবনা দিনশেষে অর্থ ধারনাতেই স্বীকৃতি পায়, আর ঘর হয় প্রাইভেট স্ফেয়ার। তাই সে পাবলিক স্ফেয়ারের সত্ত্বা থেকে হঠাৎ প্রাইভেটে ঢুকে হতাশ হতে থাকবে নাকি নিজের প্রয়োজনেই উজ্জ্বীবিত হবে, সেটার চয়েস ও তো নীরার নিজেরই। বিশেষ করে যখন চাইলেই বাস্তবতার সাথে পাল্লা দেয়া সম্ভব নয়, সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করা এবং নির্দিষ্ট পরিকল্পনাসহ ধৈর্য্য ধারন করাই ভবিতব্য. তখন সঠিক চয়েস নিবার্চন করাও কর্তব্য বৈ কি!!
বাইরের কর্মঅভ্যাস, কর্মজীবন প্রতিদিনই নীরাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। বিশেস করে যখন কোন অফিসের সামনে দিয়ে যেতে যেতে সবাইকে কাজে মগ্ন দেখে কিংবা সকাল বেলা মানুষের ব্যস্ত ভঙ্গিতে অফিসের দিকে যাওয়া অথবা অফিসের সামনে কলিগরা কফির মগ হাতে আড্ডা দেয়া দেখে, তখন তার মনটা কেমন বিষন্ন হয়ে যায়। নিজের অফিসের জন্য, কাজের জন্য, টিম ওয়ার্কের জন্য, এমন কি ডেস্ক আর চেয়ারটার জন্যও মনটা যেন হু হু করে ওঠে!! তখন সে স্মৃতিচারন করে সুন্দর ফেলে আসা দিনগুলির, যখন কর্মপরিবেশে তার পরিচিতি ছিল কাজের মধ্য দিয়েই।
কিন্তু হতাশার সাথে কোন দোস্তি নয়। তখন নীরার হঠাৎ মনে হয়েছিল, এভাবে হায় হুতাশ করে নিজের মানসিক স্বাস্থ্য খারাপ করে কি লাভ। এরচেয়ে যেটুকু সময় সে পায়, সেটাকে নিজের মতো করে কাজে লাগাবে, ভাবে সে। আবার লেখালেখি শুরু করলো সে, ছেলে হবার পরে সেই প্রথমবার। তারপর আস্তে আস্তে নিজের ওয়েবসাইট শুরু করা লেখার জন্য বা এরকম আরও অনেক কিছু। শুধু রান্না করা, বা ঘরের কাজ করায় সে সত্যিই কোন আনন্দ খুঁজে পায়না। হু, হয়তো বৈশ্বিক মূল্যায়ন নেই বলেই। শুধু ঘরের মানুষ উৎসাহ, স্বীকৃতি বা মূল্যায়ন করলে কি হবে, বাইরে তো আগে যা এখনও তাই!!! তাই বোধকরি, নারীর বেকার জীবন নিয়ে কেউ কোনদিন ভাবে না। পুরুষ বেকার হলে, সেখানে একরাশ হতাশা আর মেয়েরা বেকার হলে… ‘ সুখেই তো আছো, কাজ নাই, কর্ম নাই।’ লোকের কথা আর কি।
নীরা ভাবছে, আচ্ছা যারা বাইরে চাকরী করতে হবে, নিজের পরিচয় হেতে হবে, স্বাবলম্বী না হলে উপায় নেই টাইপ চিন্তা না করে থাকতে পারে, তারা কতই না শান্তিতে রয়েছে!! অন্য কষ্ট থাকলেও ঘর নাকি বাহির- নিজের ক্যারিয়ার নাকি সন্তান, এই টানাপোড়ান তো নেই। এই বা কম কি!! সে তো আছে আরও বিপদে। ক্যারিয়ারের কি হবে ভেবে হা পিত্তেস করছে, আবার ছেলেকে কাছে না রাখলে শান্তিও পায় না!!!
আবার নানাজনের নানা বিজ্ঞ কথা। ঘরের মানুষের চেয়ে যেন বাইরের মানুষেরই নীরার জন্য চিন্তা বেশি!! কেউ বলছে, আরে একি ঘরে বেসে আছো কেন, এত পড়াশুনা করে? কেউ বলছে, আরে ঘরে বসেই ভালো, সন্তান আগে। কেউ বলছে, আরে বসে না থেকে করবে কি……… তার কষ্ট করে তৈরী করা পরিচয়টা যেন ধূসর হয়ে যাচ্ছে।
বাইরে ব্যালকনিতে অন্ধকার নেমে এসেছে, কফির মগের ধোঁয়াটা আর নেই। বরং দূরের বাড়িগুলোতে আর রাস্তার বাতিগুলো জ্বলে উঠেছে। দূর থেকে নীরাকে দেখে মনে হচ্ছে, হেরে যাওয়া সৈনিক। হেসে ফেললো সে, এত্ত সহজ!!! সব কিছু পার করে আবার সে সামনে এগোবেই…… একা নয়..তার সন্তান, স্বামী…..সবাইকে নিয়ে…..
এবার সে ঘরে ঢুকে গেল, বাতি জ্বালিয়ে দিতে…..।
Leave a Reply