আমাদের শিশুকালের বন্ধু ইরাদ আর তার বউ রিমিকে নিয়ে এবার আমরা আবারও বেরিয়ে পড়লাম। বিশ্বাস করুন বা নাই করুন, নভেম্বরের শীতের ভেতর!! ইউরোপে সাধারনত কেউ শীতকালে না পারতে বের হতেই চায় না, সেখানে ৩ টা দেশ নন-স্টপ ঘোরা!! হলি কাউ!! এবারের গন্তব্য ছিল, প্যারিস, বুদাপেস্ট আর ভিয়েনা। ভিয়েনা আমার উইশ লিস্টের এইটি শহর, সেই ছোটবেলা থেকেেই। বুদাপেস্ট থেকে আমরা ভিয়েনার যাবার জন্য রওনা হলাম। কিন্তু সকালের প্রথম ট্রেনটা মিস করলাম। কেন? আমাদের অতি প্রিয় বন্ধুকে যদি বলি, সকাল আটটায় বের হবো, উনি কি করেন জানেন? উনি ৭:৫৫ তে গোসল করতে ঢোকেন!! অগত্যা কি আর করা!! সকালে ব্রেকফাস্ট করা হয়নি। তাই ট্রেন ছাড়তেই আমরা সবাই মিলে খাবার হান্টিং এ বেরিয়ে পড়লাম। খাবারের জায়গাটি খুব সুন্দর। অনেকটা অবজারভেশন ডেক এর মতো। কেউ বসে বই পড়ছে, তো কেউ খাচ্ছে; আবার কেউ চুপ করে বসে বাইরের দৃশ্য দেখছে।
দুপুরের দিকে পৌঁছে গেলাম ভিয়েনা মেইন স্টেশনে। ইতিহাস, সঙ্গীত, সুর, সংস্কৃতি, স্থাপত্যের অপূর্ব সৌন্দর্য-কাহিনী যে শহরের অলিগলিতে জড়ানো। আমার শুধু মনে হচ্ছিল, কি ভাবে ইউরোপের রাজকীয় অতীত ও বর্তমান সময় মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে শহরটার পথে পথে। নিজের যা কিছু ভালো, যা কিছু ঐতিহ্যময় তাঁকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার যে আনন্দ তা বোধহয় ইউরোপের মানুষ খুবই ভালো জানে। নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে প্রাণপণে বাঁচিয়ে রাখার প্রবনতা দেখেছি ইউরোপের ছোট ছোট গ্রাম থেকে শুরু করে বড় শহরগুলোতেও। এই ভিয়েনাতেই তো ফ্রয়েড থেকে শুরু করে ইউরোপের ইতিহাসের বহু গুরুত্বপূর্ণ মানুষের আনাগোনা ছিল। শিল্পকলা, সুর ও সংস্কৃতির এই শহরটি হিটলারের বড় প্রিয় ছিল, এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এই শহরে থেকেই হিটলারের বহু পলিসি তৈরি হয়েছিল। তবে ইতিহাস ‘ভিলেন’দের ধরে রাখার প্রয়োজন মনে করে না, শুধু শিক্ষা নেয়। আজকের ভিয়েনাও ইতিহাসের কোন বাজে অধ্যায়কে মনে রাখে নি। সব ভুলে আজকের ভিয়েনা মোৎজার্ট, বেটোফেনের সুরে সবাইকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে বহু দূরে।
স্টেশন থেকে নেমে বাসে করে আমাদের হোটেলে পৌঁছালাম। আমাদের হোটেলটি শহরের একদম কেন্দ্রে। চারিদিকে ক্রিসমাসের ছোঁয়া, মানুষ, মিউজিক। আহ, আমার বর সবসময় কিভাবে যেন আমার মনে মতো জায়গাতেই সুন্দর সব হোটেল খুঁজে বের করে!! আমাদের রুমের উল্টো দিকেই খুব সন্দর একটি চার্চ। মেঘলা দিনের আলোয় কেমন স্নিগ্ধ মনে হচ্ছিল। বের হবার পর মনে হচ্ছিল যেন,প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি স্থাপত্য যেন এক একটি গল্প বলার জন্যে মুখিয়ে আছে। শীতকালে বেলা চারটেতেই মরে যায়! প্রকৃতির সেই আধো অন্ধকার,আধো আলোর মাঝে ক্রিসমাসের আলো ঝলমলে রাস্তা যেন সবার মাঝে আনন্দ নিয়ে মেতে উঠেছিল!! আহ,সত্যিই অসাধারণ সেই মুহুর্ত!!
হেঁটে হেঁটে আমরা ঘুরতে শুরু করলাম।The Hofburg,Kunsthistorisches Museum and Maria-Theresien-Platz আর Vienna City Hall এর সামনে আলো ঝলমলে ক্রিসমাসের মার্কেট। আমি অনেকগুলো ক্রিসমাস মার্কেট দেখেছি, কিন্তু ভিয়েনার মতো প্রাণপূর্ণ আর একটিও লাগেনি আমার কাছে!!
রাস্তার ওপারেই ভিয়েনা ওপেরা হাউস। প্রখ্যাত সুরকার মোৎজার্ট থেকে শুরু করে বেটোফেন, সুবার্ত সহ আরও বহু সুরকারের শহর এই ভিয়েনা, তাই এ শহর সহজেই City of music এর আখ্যা পেয়েছে। অপেরা হাউসের বাঁদিকের রাস্তা ধরে একটু এগোলেই হফবার্গ রাজপ্রাসাদ। একে প্রাসাদ না বলে ছোটখাটো একটা শহর বলা যায়। ১২৭৫ সালে গোড়াপত্তন হবার পর থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত্য অস্ট্রিয়া সাম্রাজ্যের বহু ইতিহাস এবং পরিবর্তনের সাক্ষী। বিভিন্ন সম্রাট যেমন নিজের ইচ্ছে মত এর প্রাসাদের পরিধি বিস্তার করেছেন তেমনি এর পরতে পরতে জুড়ে রয়েছে নানা ধরনের স্থাপত্য শৈলী। ৫৯ একর জুড়ে বিস্তৃত হফবার্গে ১৮ ধরণের বিল্ডিং এ ২৬০০ ঘর রয়েছে। বর্তমানে অস্ট্রিয়ান জাতীয় গ্রন্থাগার, প্রত্নতাত্বিক মিউজিয়াম, বিখ্যাত রাইডিং স্কুল ছাড়াও সিসি মিউজিয়াম, ইম্পিরিয়াল ট্রেজারি, চ্যাপেল এমনকি একটা প্রজাপতি সংগ্রহশালা অবধি আছে। এই প্রাসাদের প্রতিটা গেটে বিশাল প্রস্তর মূর্তি রয়েছে কিন্তু সবেতেই অত্যাচারের প্রতিফলন। তার আগেই বিশাল রাজপথে এসে পরলাম যার উল্টোদিকে সুদৃশ্য প্রাসাদ – কিন্তু একটা নয়, একদম একই রকম দেখতে দুটো বাড়ি, মনে হয় আয়নায় দেখছি। মাঝখানে মারিয়া থেরেসার স্ট্যাচু সাথে অতি যত্নে সাজানো বাগান। এই বাড়ির একটা আর্ট হিস্টরি মিউজিয়াম আর অন্যটা ন্যাচারাল হিস্টরি মিউজিয়াম। সবেতে ঢুকতে ইচ্ছে করলেও তখন সন্ধ্যে নেমে গিয়েছে।
এখানে না বললেই নয় যে, অস্ট্রিয়ার ইতিহাসে এই মারিয়া থেরেসার মাহাত্ম্য। হাব্সবার্গ রাজবংশের শেষ সাম্রাজ্ঞী ছিলেন এই মারিয়া থেরেসা। অষ্টাদশ শতকের শেষার্দ্ধে ৪০ বছরের রাজত্বে অষ্ট্রিয়ার পরিধি যেমন বিস্তার করেছিলেন তেমনি অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সংস্কারক হিসেবেও যথেষ্ট খ্যাতি লাভ করেছিলেন। অস্ট্রিয়া ছাড়া, হাঙ্গেরি, বোহেমিয়া, ইতালির কিছু শহর, নেদারল্যন্ডের বেশ কিছুটা এসময় তার অধিনস্ত ছিল। এছাড়া ইউরোপের বাকি রাজাদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন নিজের ১১ জন কন্যাকে বিভিন্ন রাজার সাথে বিয়ে দিয়ে। এই থেরেসা মারিয়ারই কন্যা মেরি আঁতিনয়েত, যিনি ফ্রান্সের রাণী ছিলেন ফরাসি বিপ্লবের সময়।
ইউ ভান এ করে গেলাম ইতিহাসের নানা সময়ের নানা ঘটনার সাক্ষী St. Stephen’s Cathedral এ। রঙিন টাইলসের ছাদ, সূচলো আকাশচুম্বী গথিক চূড়া যেন মনকে শান্ত করে দেয়। St. Stephen’s Cathedral এর সামনে প্রচুর ভিড়। ঘোড়ার গাড়ি, অপেরার টিকিট বিক্রেতার আকর্ষণীয় পোশাক, ঐতিহাসিক চার্চ সব মিলে মিশে এই জায়গার সুরটি যেন সেই অতীতেই রয়ে গেছে, সময় এখানে থমকে দাঁড়িয়েছে।
ভিয়েনার শহরকেন্দ্র থেকে একটু দূরে Schönbrunn Palaceএ রওনা দিলাম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে। বিশাল বড় প্যালেসে ঘোরার জন্য নানা ধরনের টিকেট রয়েছে যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কিন্তু বাইরে থেকে ফিরে যাবার পাত্র আমরা নই। প্রাসাদের অনেকখানি অংশ দেখার সৌভাগ্য হলো লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট কাটার পর। সাথে দিলো অডিও রেকর্ড। সতেরশ শতাব্দীতে জায়গাটি নেপোলিয়নের হেড কোয়ার্টার ছিলো। উপরে যে বিল্ডিংটি দেখা যায় বাগা থেকে সেটিই ছিলো নেপোলিয়নের প্রাসাদ । দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পরে এই প্রাসাদ মিত্রশক্তির অস্থায়ী অফিস ছিল। বর্তমানে এই প্রাসাদ UNESCO World Heritage। এই প্রাসাদে ১৪৪১ এর অধিক রুম রয়েছে। রানী মারিয়া থেরেসা ও রাজা জোসেফের রুমগুলো এখনও এমনভাবেই সাজানো রয়েছে যেন মনে হচ্ছিল, এখনই তারা উঠে তৈরী হবেন, বা প্রাতঃরাশ করবেন! এতটা জীবন্ত করে রাখতে পারা একমাত্র ইউরোপীয়দের পক্ষেই সম্ভব!!
প্রাসাদ থেকে বের হলেই বিশাল বাগান নানা রঙের ফুলে সাজানো, যেন সবুজ ঘাসের গালিচায় নক্সা আঁকা। ঘাসের জমি ছাড়িয়ে বাগানের ভেতরে সযত্নে ছাঁটা গাছের পাশে পাশে প্রচুর স্ট্যাচু সাজানো। এই বিশাল বাগানে সারাদিন ধরে হাঁটলেও যেন পথ ফুরোবে না। দূরে ফোয়ারা লক্ষ্য করে বহু মানুষ হেঁটে চলেছে। হাঁটতে হাঁটতে ছোট্ট এক টিলার উপরে এক সুন্দর স্থ্যাপত্য ‘Gloriette’ নজরে পড়ে। এই জায়গা থেকে পুরো প্রাসাদের দৃশ্য দেখা যায়। ধূসর ভেজা ভেজা দিনে অতীতের রাজপ্রাসাদের রাজকীয় উঠোনে নিজেদেরকে অতীতের এক বৈভবশালী চরিত্র কল্পনা করে হেঁটে যাই, ভালো লাগে মেঘলা দিনের এই ফ্যান্টাসি।
Leave a Reply