কিচেন থেকে ইরাদকে ডাক দিয়ে বাবাই জানতে চাইলো, তুই কি এখন খাবি? খাবার মাইক্রোওভেনে দিবো?
ইরাদের চটপট উত্তর, দে। আমি আসতেছি।
এই কথপোকথনের সময় ছিল ৬টা বাজার মাত্র পাঁচ মিনিট আগে। কেন সময়টা বললাম? কারণ, আমাদের ট্রেন ছাড়ার সময় ভোর ৬:১৫। আমাদের বাসা থেকে বানহফে (ট্রেন স্টেশন) পায়ে হেঁটে যেতে সময় লাগে প্রায় ৭-৮ মিনিটের মতো। আর ইরাদ কনকনে শীতের সকালে গোসল সেরে রেডি হতে গেলো!! আবার দুই বন্ধু খাবার সংক্রান্ত আলোচনাও করছে!! কেয়া বাত!! অন্য কেউ হলে আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যেতাম। কিন্তু এক্ষেত্রে কেন হলাম না? কারণ এই বালকসুলভ ভদ্রলোকটি আমার আর আমার বরের শিশুকাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রিয় বন্ধু। বিশেষ করে আমার বর আর তার বন্ধুত্ব অন্য লেভেলের। সদ্য বিয়ে করে মিষ্টিমতো বউসমেত উনি ইউরোপ ট্যুরে বের হয়েছেন। সবাই রেডি, শুধু ইরাদ বাদে!! এই হলো আমাদের ইরাদ। আমি পুত্রকে নিয়ে আগেই দৌঁড়ে বের হয়ে গেলাম। বাবাই বললো, ওদের নিয়ে সে আসছে। বিশ্বাস করুন, আমার চোখের সামনে দিয়েই ট্রিনটি নির্দিষ্ট সময়ে ছেড়ে গেল!! তখনও তারা স্টেশনে পৌঁছাতে পারেনি। আমরা তড়িৎ গতিতে বের হয়ে গেলাম ট্যাক্সির খোঁজে। বের হয়ে দেখি বৎস হাস্যজ্জ্বল মুখে বলছে, যাহ্ আমাদের রাইখ্যাই গেল গা!!!
এখন ট্রেনের কানেকশনের ব্যাপারটা বলি। আমাদের ঐ ট্রেনে করে ফ্যাঙ্কফুর্টের হফটবানহপে (মেইন স্টেশনে) যাওয়ার কথা ছিল যেখান থেকে আমার প্যাসিরগামী ট্রেনটি ছাড়বে এবং যথাসময়েই ছাড়বে। ঐটা আইসিই মানে জার্মানী থেকে অন্য দেশে যাবার জন্য। ঐটাও যদি মিস হয় তাহলে সব প্ল্যানের এখানেই সমাপ্তি। কোথায় যাচ্ছি? আমরা রাতের প্যারিস দেখতে যাচ্ছি। যাক শেষ পর্যন্ত আমরা সবাই যাত্রা শুরু করলাম। আইসিই ট্রেনের গতি থাকে ঘন্টায় প্রায় ৩৫০। জার্মানী থেকে প্যারিসে যেতে প্রায় সাড়ে ৩-৪ ঘন্টার মতো সময় লাগে।
প্যারিসে পৌঁছে বাসস্টপেজ খুঁজতে লাগলাম। কোন বাসটা আমাদের হোটেলের দিকে নিয়ে যাবে মোবাইলের অ্যাপসে খুঁজতে খুঁজতেই কিছু সময় পেরিয়ে গেল। অবশেষে হোটেলে পৌঁছালাম। ঠিক করলাম ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ করতে বের হবো। খুঁজে খুঁজে একটা দোকান পছন্দ হলো। প্রচন্ড ভিড়!! খাবার অর্ডার করলাম। কিন্তু হায় রে, সময় পেরিয়ে যায় ,খাবার দেবার আর সময়ই হয় না। এমন ক্ষুধা লেগেছে যে, মনে হচ্ছে দেই কারও মাথা ফাটিয়ে। এদিকে আমাদের পুত্রও অস্থির হয়ে গিয়েছে। আমি ভাবছিলাম, দেশে হলে মনে হয় এতক্ষণ মারামারিই বাঁধিয়ে দিতাম!! প্রায় ১ ঘন্টা পরে খাবার সার্ভ করলো এবং দেরি করার জন্য ক্ষমা চাইলো। আমরা মোটেও ক্ষমা না করে খেতে শুরু করলাম। ইয়া খোদা!! কি বাজে রান্না!! সবাই ভারাক্রান্ত মনে সেটাই খেলাম। আমি একটু চুপ মেরে গেলাম ভয়ে। কারণ বাবাই বলেছিল যে, সবার জন্য ডোনার বা বার্গার কিনে খেতে খেতে দেখা শুরু করা উচিৎ। আমিই বাগড়া দিয়ে বলেছিলাম, না চলো কোথাও বসি, কতক্ষণ আর লাগবে। দল ভারি করার জন্য আবার নতুন বউ রিমিকেও বলেছিলাম, তাই না বলো? অগত্যা চুপ থাকাই নিরাপদ, তাই না বলেন?
প্যারিসে দেখার এত কিছু আছে যে ৪-৫দিনেও মনে হয় দেখে শেষ করা যাবে না। তবে আমাদের যাবার উদ্দেশ্য ছিল শুধু রাতের প্যারিস দেখা, দ্য সিটি অব লাইট!! রাতের শহরকে দেখার সবচেয়ে ভাল উপায় হলো একদম উঁচু থেকে পুরো শহরটাকে উপভোগ করা। এর অন্যরকম রোমাঞ্চ আছে বৈকি। তাই রেস্তোরা থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঘুরে দেখবো বলে আমরা ঠিক করলাম। পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে উঠলাম অনেকখানি ওপরে। প্রথমেই আমরা ঠিক করলাম ব্যাসিলিক দু সাক্রে কর (Basilique du Sacré-Cœur) তে যাবো। বিকেল আর গোধূলীর শহরের গায়ে কিভাবে খেলা করে সেটাই দেখবো। ভাবছেন, চার্চে গিয়ে আবার এসব কিভাবে দেখা যায়? চার্চের ঠিক সামনেই বিশাল চত্বর। সেখানে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার টুরিস্ট কর্মব্যস্ত শহরকে দেখছে। ব্যস্ত শহরকে সবার অগোচরে উপভোগ করতে পারাতেও বোধহয় একটা মাদকতা রয়েছে, নইলে এত এত মানুষ শুধু সামনেই চেয়ে রয়েছিল কেন? কেনই বা আমারও সেখান থেকে ফিরে আসার সময় মন কেমন করছিল! নামার সময় আমরা ক্যাবল কারের টিকেট কেটে নিচে নামলাম।
এবার গন্তব্য রাতের আইফেল টাওয়ার। আমরা আইফেল টাওয়ার দুটো জায়গা থেকে দেখবো বলে ঠিক করলাম। একটা নিচে থেকে, আরেকটা Jardins du Trocadéro (Gardens of the Trocadero) এর ওপর থেকে। প্যারিস সিটিতে ঘুরে বেড়ানোর জন্য সবচেয়ে সহজ যোগাযোগ মাধ্যম হচ্ছে মেট্রো। টিকেট কেটে রওনা হলাম। পৌছে দেখি বেশ ভিড়। টাওয়ারের চূড়ায় উঠার জন্য রয়েছে এলিভিটর ও সিড়ি। হাজার হাজার দর্শনার্থী আইফেল টাওয়ারের আশে পাশে জটলা করে রেখেছে। কেউ ছবি তুলছে আবার কেউ টাওয়ারের পাশ দিয়ে বহমান সেন নদী তীরে দাড়িয়ে টাওয়ারের সুন্দর্য উপভোগ করছে ।নদীতে আবার রয়েছে ক্রজ লাইনও দেখতে পেলাম।হঠাৎ সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠলো একসাথে। তাকিয়ে দেখি পুরো আইফেল টাওয়ারে আলোর খেলা শুরু হয়েছে। জানতে পারলাম প্রতি এক ঘন্টা পরপর এভাবে আলোর খেলা চলে! ঠিক করলাম পরের আলোর খেলাটা নাহয় Jardins du Trocadéro থেকেই দেখবো।সেখান থেকে আইফেল টাওয়ারের রাতের সৌন্দর্য দেখে মনে হলো যেন চোখ আটকে গিয়েছে আমার! একটা বদখত দেখতে লোহার টাওয়ারও যে রাতের বেলায় এমন সুন্দর দেখাতে পারে, না দেখলে সত্যিই ফটোশপের কারসাজি বলেই ধরে নিতাম!
এবার খানিকটা ট্র্যাজেডি!! কি হলো কি হলো? প্রতিবার মেট্রোর টিকেট পাঞ্চ করে আমাদের টিম লিডারের কাছে জমা দিতাম। টিম লিডারটা আবার কে? আমার বর!! আমাদের সমস্ত প্ল্যান, হোটেল ঠিক করা সবই তারই করা। এবার যখন আইফেল টাওয়ার থেকে লুভর মিউজিয়ামের দিকে যাবো বলে ঠিক করেছি,তখনই বিপত্তি ঘটলো!! সে আর কি বলবো!! তখন রাত প্রায় ৮:৩০ টা, সবাই টিম লিডারের কাছে টিকেট জমা দিয়ে এগোচ্ছি তখনই দেখতে পেলাম সব দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বাইরে যাবার। হলোটা কি? এদিকে ফ্রেঞ্চে কি যেন বলেই যাচ্ছে, আমরা কি আর থোড়াই বুঝতে পারছি। সামনেই দেখলাম সবার টিকেট চেকিং করছে রেলওয়ে পুলিশ। আমাদেরগুলো দেখতে চাইলো।তখনই ঘটলো ঘটনা। একজনেরটা বাদে আর কারও ব্যবহৃত টিকেটগুলো খুঁজেই পাওয়া গেল না। আমাদের তখন আত্মা শুকায় ভয়াবহ অবস্থা!! রিমির টিকেট পাওয়া গিয়েছে, তাকে আর আমার পুত্রকে অন্য সাইডে দাঁড়া করিয়ে বাহাচ শুরু হলো। মনে হচ্ছিল হার্টের ধুকপুক যেন এক মাইল দূরে থেকেও শোনা যাবে। আমাদের ফাইন করা হলো এবং কোনভাবেই আমরা বিশ্বাস করাতে পারলাম না যে,আমাদের সত্যিই টিকেট ছিল!! ১২০ ইউরো ফাইন হলো। মনে হলো আমরা কেঁদেই ফেলবো। আমার বরের চোখমুখ লাল হয়ে গেল দুঃখে আর রাগে। আমাদের দেশে কিন্তু এধরনের কেস/সিচুয়েশন খুব সহজেই ডিল করা সম্ভব আপনারা সবাই নিশ্চয়ই সেটা জানেন। কারণ সবাই কারনে বা অকারণে ভুক্তভোগী। কিন্তু এখানে আইন খুবই কড়া, তারচেয়েও বড় কথা সবাই সেটা ফলো করছে। এমনকি নিরাপত্তার খাতিরে এবং অবাঞ্চিত ঘটনা এড়াতে রাত ১০টার ভেতরেই মেট্রো বন্ধ করে দেয়া হয়ে থাকে।
যাক, নিজেদের অসতর্কতায় গচ্চা দিয়ে তখন আমরা সবাই বিমর্ষ। লুভর মিউজিয়ামও তখন বন্ধ করে দিয়েছে। তবে, মিউজিয়ামের সামনে তখনও অনেক টুরিস্ট। তখন আমাদের কাররই আর কিছুই ভাল লাগছে না। কেমন যেন একটা চোর চোর ফিলিং হচ্ছে। টিকেট কাটলামও টাকা দিয়ে, আবার হারিয়েও টাকা গচ্চা দিতে হলো। আমরা হোটেলে ফিরবো; কিন্তু, কেউই আর মেট্রোতে ফিরতে চাইলাম না। খুঁজে খুঁজে বাস স্টপেজে গেলাম আর বাসের অপেক্ষায় থাকলাম।
ভেবেছিলাম রাতে ফরাসি রেস্তোরাতে বসে ডিনার সেরে নিবো। আর ভাল লাগলো না, তাই হোটেলে ফিরেই খাওয়া শেষ করলাম। পরের দিন হাঙ্গেরীতে যাত্রা করবো, তাই মনের দুঃখ আপাতত বাক্সবন্দি করে রেখে পরের দিনগুলোতে ঘুরে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়লাম। আর বাইরে তখনও আলো ঝকমক করছে, তখনও জেগে আছে রাতের প্যারিস!!
Leave a Reply